বর্তমান বিশ্বে পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা আর প্রযুক্তির আগ্রাসন তৈরি করেছে নানা সংকটের। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ প্রযুক্তি আসক্তিতে পড়ে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপরাধে। মাদকাসক্তি, ইভটিজিংসহ নানা অপকর্মে উঠছে তাদের নাম। পশ্চিমা আদলে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। যৌথ পরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে একক পরিবার। একই ভবনে বসবাস করা এক পরিবারের কাছে অন্য পরিবার অচেনা। কমে গেছে খেলার মাঠ, বিনোদনের জায়গা। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা তাই শিশু-কিশোরদের অপরাধ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের ওপরই বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা বলছেন, মূলত পরিবারের যত্নের অভাবেই শিশু-কিশোররা বিপথে চলে যাচ্ছে। সমাজও এ-ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, সন্তানের সঠিক পরিচর্যা, তাদের হাত খরচ, নিয়মিত স্কুলে যায় কি না, তারা কোথায় কী করছে এসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে। এ-ক্ষেত্রে বাবা ব্যস্ত থাকলে মাকে দায়িত্ব নিয়ে সন্তানের সব ভালোমন্দের খোঁজ রাখতে হবে। সমাজে যেসব সন্তান আজ প্রতিষ্ঠিত তাদের প্রত্যেকের পেছনে বাবা-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যেসব বাবা-মা তাদের সন্তানদের পেছনে নিবিড়ভাবে লেগে থাকেন তাদের সন্তানরা বিপথে যাওয়ার সুযোগ পায় না। একই সঙ্গে ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের প্রত্যেকটি ভবনে বাচ্চাদের খেলার জন্যে একটি নির্দিষ্ট প্লে গ্রাউন্ড রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, নিজ সন্তানের প্রতি নজর রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের ভেতরে পড়ে। তাই বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে একটাই মেসেজ থাকবে- সন্তানের সঙ্গে মিশুন, তার কথা শুনুন এবং আপনার ব্যক্তিগত কিছু সুখ-দুঃখের গল্প বা বিষয় বন্ধুসুলভ আচরণ নিয়ে শিক্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করুন। এতে করে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে। একইসঙ্গে আপনার সন্তানের যদি ব্যক্তিগত কোনো অভাব, আকাঙ্ক্ষা, না পাওয়ার বেদনা, ক্ষোভ থাকে সেটাও সে অনায়াসে আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে। এতে করে সন্তান বিপথে যাবে না। এক কথায় সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকবে না।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, আমার সন্তানের দিকে আমাকেই নজর দিতে হবে। আপনার সন্তানের দিকে আপনার। এটা অনেক আদি সময় থেকেই চলে আসছে। যার যার সন্তান তার তার সম্পদ। কাজেই নিজের ব্যক্তিগত সম্পদকে আমি কীভাবে নিরাপত্তা দেবো; সেটি আমার উপর নির্ভর করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, কিশোর সন্তানকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে বাবা-মা দুজনেরই বাচ্চাকে সময় দিতে হবে। তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে যেতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তারা কি বলতে চায়- সেটা মন দিয়ে শুনতে হবে। কোনটা তাদের জন্যে ভালো, কোনটা মন্দ সেটা তাদের বোঝাতে হবে, দেখাতে হবে, শেখাতে হবে। কারণ একটা বাচ্চা মানুষ করা সোজা কথা নয়। সত্যি বলতে আমরা নিজেরাই কনফিউজড যে বাচ্চাকে আমরা বুকে জড়িয়ে ধরে মানুষ করব, নাকি ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে। বর্তমান সময়ে আমরা বাবা-মায়েরা এতো বেশি আধুনিক আর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকি যে বাচ্চাকে প্রপার টাইম দেয়ার মতো যথেষ্ট সময়ই থাকে না। প্রত্যেক বাবা-মায়েরই উচিত নিজ নিজ বাচ্চার কাছে একজন মডেলে পরিণত হওয়া। যেন তারা বড় হয়ে বাবা-মায়ের মতোই হতে চায়। আর বাচ্চারা যদি কোনো মডেল বা আইডলই না পায় তাহলে তারা বড় হবে কীভাবে, আর স্বপ্নই দেখবে কীভাবে।
সমাজ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইদানীং শিশু-কিশোরদের একটা বিশাল অংশ, যারা ছোটবেলা থেকেই স্মার্টফোনে আসক্ত। দেড়-দুই বছরের বাচ্চা বাবা-মায়ের ফোন নিয়ে গেম ডাউনলোড করে খেলছে। বাবা-মা ভীষণ গর্বিত। সেই বাচ্চারা নিজের বাসায় সারাক্ষণ ফোনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। এমনকি আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে গিয়েও ফোন নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে খেলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার বদলে বাবা-মা কী পায়? পায় নিরবচ্ছিন্ন আড্ডার সুযোগ। সন্তান তাদের বিরক্ত করে না। তার বদলে ভবিষ্যতে বাবা-মা এমন একটি ছেলে বা মেয়ে পায় যে প্রযুক্তি ও পণ্য আসক্ত, কল্পনাশক্তিহীন এবং বইপাঠে অনিচ্ছুক। আজ যে স্মার্টফোনটা সে ব্যবহার করে, কাল নতুন ফোনের জন্যে তার বায়না খুব স্বাভাবিক। আজ যে বাচ্চাটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার কোনো কারণ নেই, তারই একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে। অথচ যে বয়সে সন্তানের হাতে তুলে দেয়ার কথা রঙ-বেরঙের বই, রঙিন পেন্সিল, সেই বয়সে তারা তুলে দেন স্মার্টফোন আর ওয়াইফাই কানেকশন। এখানে অসুবিধা একটাই। রঙিন বই, খাতা আর রঙপেন্সিল দিয়ে বসিয়ে সেগুলো ব্যবহারের সময় সন্তানের পাশে থেকে তাকে সময় দিতে হয়। কিন্তু স্মার্টফোনে তো তা না করলেও চলে। ফলে ফোনটি তার হাতে দিয়ে নিজেদের জগতে চলে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু তারা জানেনও না, কত বড় ক্ষতি তারা সন্তানের করেন।
এসব বাবা-মা ব্যস্ততায় কাটান সারাদিন। সন্তানদের সময় কাটে একা একা। শুরুটা স্মার্টফোনে ভিডিও গেমস, কার্টুন দেখার মধ্যদিয়ে এবং পরবর্তীতে ফেসবুকজাতীয় ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে যায় শিশু-কিশোর। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাওয়া কমে যায়। বাসা থেকে খুব কমই বের হয়। ফলে অনেকটাই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে শিশু-কিশোররা। তাই ভার্চুয়াল ভাইরাসের এই আগ্রাসন থেকে নিজেকে, পরিবার ও সমাজকে বাঁচাতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া জরুরি।