ইলিশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রজনন ক্ষেত্রের ৭০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য অধিদফতর।
প্রধান প্রজনন মৌসুমে ‘মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০১৮’ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর এ ঘোষণা দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। এই ২২ দিন সুন্দরবনসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা এবং মোহনাসমূহেও কঠোর নজরদারি রাখা হবে বলেও ওই সভায় জানানো হয়।
কিন্তু এরইমধ্যে বাংলাদেশের নদনদী থেকে শুরু করে মোহনা ও সমুদ্রে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ শিকার শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগ মুহূর্তে জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ায় খুশি জেলেরা।
এদিকে সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই ২২ দিন জেলেরা আদেশ অমান্য করলে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখেছে মৎস্য অধিদফতর। কিন্তু দণ্ডের তোয়াক্কা না করেই হরদম চলছে ইলিশ শিকার।
মৎস গবেষকরা মনে করেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়টা ইলিশের প্রজনন মৌসুম। এসময় ডিমওয়ালা মা ইলিশ সাগর থেকে স্রোতযুক্ত মিঠাপানিতে এসে ডিম ছাড়ে। আর এজন্যই সরকার ঘোষিত ২২ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
এদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ জালে ধরা পড়লেও বরফ সংকটে তা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা ইলিশের বাজারেও। তবে মাছের দাম বাজারে কম হলেও জালে মাছ পড়ায় জেলেরা লাভের মুখ দেখছেন।
এ বিষয়ে লৌহজং জেলে সমিতির সভাপতি পরিমল মালো গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগে বর্তমানে শুধু চাঁদপুর ও মাওয়াতেই দৈনিক ৩০০ মণের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে। তাতে বাজারে ইলিশের দাম কমে গেছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ছোট আকারের ইলিশ আড়াইশ থেকে তিনশ টাকায় এক কেজি ওজনের মাছ ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে এবং বড় ইলিশের দাম পড়ছে মাত্র ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। যোগান বেশি থাকায় রাজধানী ঢাকাতেও ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা কেজি দরে।’
চট্টগ্রাম মেরিন সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান মনে করছেন, হঠাৎ করে এতো ইলিশ জালে পড়ার কারণ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং সামুদ্রিক নিম্নচাপ। একসময় অবাধে ইলিশ আহরণের কারণে বছরের প্রায় প্রতিটি সময় ইলিশের সংকট থাকতো। তবে সরকার মাছের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কারেন্ট জাল জব্দ, জাটকা ধরায় কড়াকড়ির কারণে এখন জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে বলে জানান তিনি।
তিনি মনে করেন, সামুদ্রিক নিম্নচাপ এবং সাইক্লোনের সময়গুলোতে জেলেরা ট্রলার নিয়ে সাগরে যেতে পারে না। বছরে ২০ থেকে ২৫টি নিম্নচাপে অন্তত ৪০-৪৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে জেলেদের। এই সময়টাই ইলিশের প্রজননে দারুণ ভূমিকা রাখে।
মাওয়ার ইলিশ বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এ বছর ইলিশের মৌসুম শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর্যন্ত নদীতে ইলিশ তেমন পড়েনি। দামও ছিল তুলনামূলক বেশি। এখন শেষ সময়ে এসে ইলিশ পড়ছে, দামও ব্যাপক কমেছে, সবাই ইলিশও কিনছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন ইলিশ কিনতে বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন।
মৎস্য অধিদফতর খুলনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মনিষ কুমার মণ্ডল বলেন, এ বছর মৌসুমের শুরুর দিকে তেমন ইলিশ ধরা পড়েনি। এখন প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন মোকাম থেকে মূলত খুলনার বাজারে প্রচুর ইলিশ আসছে। স্থানীয় নদনদীতেও জেলেরা ইলিশ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশে ইলিশের প্রজন ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে— চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার শাহের খালী হতে হাইতকান্দী পয়েন্ট, ভোলার তজুমুদ্দীন উপজেলার উত্তর তজুমুদ্দীন হতে পশ্চিম সৈয়দপুর আওলিয়া পয়েন্ট, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতা চাপালি পয়েন্ট এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবদিয়া হতে গণ্ডামার পয়েন্ট।
এছাড়া প্রজননের লক্ষ্যে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গোপালগঞ্জ জেলার নদ-নদীতে সকল প্রকার মাছ ধরা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে মৎস অধিদফতর।