ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিকভাবে কারো মৃত্যু হলেও মৃতদেহ নিয়ে আত্নীয়-স্বজনরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এতবছর যাবৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হতো না। কিন্তু হঠাৎ তিনদিন ধরে এই রীতি-নীতি পাল্টে গেছে।
হাসপাতালের পরিচালক তিনদিন আগে থেকে এই নির্দেশ দিয়েছেন, সব মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করতে হবে। গত তিন দিনে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৫ জন রোগীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা য়ায়। সেগুলো আত্নীয়-স্বজনের কাছে না দিয়ে মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দেন মেডিকেল অফিসার।
হঠাৎ কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে মর্গে জমছে মৃতদেহের সারি। পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে আসা স্বজনদেরও পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বুধবার বেলা সোয়া ১১টা। লালবাগ শেখসাহেব বাজার এলাকা থেকে মোছলেম ব্যাপারী (৬৮) নামে এক ব্যক্তিকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন স্বজনরা।
চিকিৎসক তাকে দেখে একটি ইসিজি করতে দিলেন। কিন্তু ইসিজি করার আগেই মারা যান মোছলেম ব্যাপারী।
বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯ জন মারা যান হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। কেউ মারা গেছেন হৃদরোগে আবার কেউ মারা গেছেন ব্রেইন স্ট্রোক করে আবার কেউ মারা গেছেন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে।
লালবাগের মৃত মোছলেম ব্যাপারীর ছেলে জিদনী ব্যাপারী জানান, আমার বাবা দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। আজ বুধবার বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসক আমার বাবার ময়নাতদন্তের জন্য সুপারিশ করলেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম না কেন তার ময়নাতদন্ত করতে হবে? সাধারণ মৃত্যুর জন্য তো ময়নাতদন্তের দরকার হয় না। জানতে পারলাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন ধরে এ নিয়ম শুরু করেছে।
জিদনী বলেন, তখনই আমরা একটি কাগজ নিয়ে ছুটে যাই লালাবাগ থানায়। ফোন দেওয়া হয় আমাদের এলাকার সাবেক এমপি বর্তমান বিএমএএর সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে। তিনি লালবাগ থানায় ফোন দিয়ে আমার বাবার লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু লাশ দাফন দিতে দিতে সারাদিন লেগে যায়।
জিদনী অভিযোগ করে বলেন, এর আগে এমন নিয়ম কখনও দেখিনি। কারও স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মৃতদেহ এমনিতেই দিয়ে দিত। এখন ময়নাতদন্তের এই ঝামেলার কারণে অনেকেরই কষ্ট বেড়ে গেল।
বুধবার সন্ধ্যায় পটুয়াখালীর বাউফল থেকে আসা আ. খালেক ( ৭০) । বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তার ছেলে মো. সেলিম জানান, বুধবার সকালে চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী থেকে সন্ধ্যায় ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসলে তিনি মারা যান। মরদেহ ময়নাতদন্ত করার কথা বলেছেন চিকিৎসক।
রাত ৯টায় তিনি বলেন, এখনও শাহবাগ থানায় আছি। রাত কয়টা বাজবে জানি না।
মৃতদেহ ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্তের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আসা বিল্লাল হোসেন (৪৫), ঢাকার খিলগাঁওয়ের গোরানের আ. কাদির (৫০), নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ওবায়দুল হক। মৃতদেহ নিতে তাদের অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মশিউর রহমানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে এখানে আছি। কিন্তু এমন আইন এই প্রথম দেখলাম। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তিনদিন যাবৎ হাসপাতালের পরিচালক এ নিয়ম চালু করেছেন।
তিনি বলেন, বাড়তি ময়নাতদন্তের কারণে আমাদের ভোগান্তি হচ্ছে। এটি বন্ধ করা উচিৎ। আর এতে লাভবান হচ্ছে হাসপাতালের কিছু লোক ও থানা পুলিশ। আশা করি এ আইন দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে।
জরুরি বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত মো. ফজল নামে এক কর্মচারী জানান, এ রকম নিয়ম তো আগে দেখি নাই। যে কেউ মরলেই ময়নাতদন্ত করতে হচ্ছে।
জরুরি বিভাগের হারুন অর রশীদ নামে একজন স্টাফ ব্রাদার বলেন, এমন নিয়ম করা ঠিক হয়নি। এতে মৃতদেহ নিয়ে স্বজনদের বহু বেগ পোহাতে হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আপনাকে আমি চিনি। এর আগেও নিউজ নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এবার নিউজের বিষয়ে কোনো কথা বলতে আমি রাজি নই। এই দিকে জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আলাউদ্দীন জানান, পরিচালকে নির্দেশে আমরা কাজ করছি। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।
তিনি আরো বলেন, নতুন করে মৃত্যুর সনদপত্র ছাপানোর কারণে এ ব্যবস্থা নিয়েছে পরিচালক। তবে মৃতের স্বজনদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হবে।
শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক ( এসআই) মো. নিয়াজ বলেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয় নাই। স্বাভাবিক রোগীর মৃত্যু কোনো সময় ময়নাতদন্ত হয়নি। এই প্রথম শুনলাম স্বাভাবিক মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করতে হবে। এতে মৃতের আত্নীয়-স্বজনদের দূর্ভোগ পোহাতে হবে অনেক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সিদ্ধান্তটির সমাধান করা উচিত।