সুস্থ-সবল হাড় গঠন সুস্বাস্থ্যের জন্য এবং জীবনের সকল পর্যায়েই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।আপনার শৈশব, কৈশোর তরুণ-যুব বয়সের খাবারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ সমূহ আপনার হারের অন্তর্ভুক্ত হয়।একসময় আপনি ত্রিশের কোঠায় পা দেন, তখন আপনি হাড়-ভরের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেন। এই সময়ের মধ্যে যদি কোন কারণে আপনার পর্যাপ্ত হাড়-ভর (bone mass) তৈরি না হয়, কিংবা পরবর্তীতে হাড়-ভর হ্রাস পায়, তাহলে হাড়-ভঙ্গুরতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়তে থাকে, যার ফলে হাড় সহজে ভেঙ্গে যেতে পারে।
সৌভাগ্যবসত, অনেক পুষ্টিকর খাবার রয়েছে, যেগুলো খেলে এবং জীবনধারায় কিছু অভ্যাস যোগ করতে পারলে সেগুলো আপনার শক্তিশালী হাড় গঠনে সাহায্য করতে পারে এবং বয়সকালে হাড় সুস্থ রাখতে এবং এর ভর বা ঘনত্ব বজায় রাখতেও সাহায্য করতে পারে।
এখানে প্রাকৃতিক উপায়ে সুস্থ হাড় গঠনের ১০টি উপায় নিয়ে আলোচনা করা হল:
১.প্রচুর শাকসবজি খান
আপনার হাড়ের জন্য শাকসবজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ভিটামিন সি’র সবচেয়ে ভাল উৎস, যা হাড় গঠনকারী কোষ (cells) উৎপাদনকে জোরদার করে। এছাড়া কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ভিটামিন সি’র এন্টিঅক্সিডেন্ট হাড়ের কোষকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
শাকসবজি হাড়ের খনিজ ঘনত্বকেও (bone mineral density) বৃদ্ধি করতে পারে, যা হাড়ের ঘনত্ব (bone density)নামেও পরিচিত।
হাড়ের ঘনত্ব হলো আপনার হাড়ের মধ্যে পাওয়া ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের পরিমাণের পরিমাপ। অস্টিওপেনিয়া (osteopenia) বা হাড়ের কম ভর (low bone mass) এবং অস্টিওপরোসিস (osteoporosis ) বা ভঙ্গুর হাড় (brittle bones) উভয়কেই low bone density বা হাড়ের ঘনত্ব কম বলে পরিগণিত করা হয়।
শৈশবকালে অধিক পরিমাণে সবুজ ও হলুদ শাকসবজি গ্রহণ করলে হাড়ের খনিজায়ন বা ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তরুণ ও পরিণত বয়সে হাড়ের ভর বজায় থাকে। ,
প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি গ্রহণ বয়স্ক নারীদের জন্যও খুব উপকারী। পঞ্চাশোর্ধ নারীদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা খুব কম পেঁয়াজ খেয়েছেন তাদের তুলনায় যারা বেশি বেশি পেঁয়াজ খেয়েছেন তাঁদের অস্টিওপরোসিসের ঝুকিঁ কমেছে ২০%।
বয়স্কদের মধ্যে অস্টিওপরোসিসের এক বড় ঝুঁকি হাড় উল্টানো বা ভাঁজ বা হাড় ভেঙ্গে এবং নতুন হাড় গঠনের প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাওয়া।
তিন মাসের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী এই সময়ে ৯টির বেশি ব্রোকলি, বাঁধাকপি, পার্সলী অথবা অন্যান্য হাড়-প্রতিরক্ষামূলক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ ভোজন করেছেন তাদের হাড় ভাজ বোন টার্নওভার কমেছে।
সারাংশ: শৈশবকালে প্রচুর শাকবজি খাওয়া সুস্থ হাড় গঠনের সহায়ক।এর ফলে যৌবন এবং বৃদ্ধ বয়সে হাড়ভর বজায় থাকে।
২.স্ট্রেংথ ট্রেনিং ও ভারবহন ব্যায়াম
বিশেষ ধরনের ব্যায়ামের অনুশীলনে সম্পৃক্ত থাকা আপনার সুর্দঢ় হাড় গঠন এবং তা অটুট রাখতে সাহায্য করতে পারে।
সুস্থ হাড়ের জন্য সবচেয়ে ভাল ব্যায়াম গুলোর অন্যতম হলো ভার বহন বা উচ্চ-প্রভাবযুক্ত ব্যায়াম,যা নতুন হাড় গঠনে সাহায্য করে। শিশু সহ টাইপ ওয়ান ডায়বেটিসে আক্রান্ত মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, এধরনের শরীরচর্চা হাড় গঠনের চূড়ান্ত বছর গুলোতে হাড় গঠনের প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। উপরন্তু এ ধরনের ব্যায়াম বৃদ্ধ বয়সে হাড় ক্ষয় রোধ করে। ,
যে সব বয়স্ক নারী-পুরুষ ভার বহনের মত শরীর চর্চা করেন তাদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের কঠোর ব্যায়াম করার কারণে তাদের হাড়ের খনিজ ঘনত্ব, শক্তি এবং আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি হাড় বাঁকা হওয়া বা ভাজ এবং ব্যাথা লক্ষন কমে গেছে।
তবে, আরেকটি গবেষণায় যেসব বয়স্ক পুরুষ ৯ মাসের বেশি সর্বোচ্চ লেভেলের ভার বহনের শরীরচর্চা করেছেন তাদের হারের ঘনত্ব সামান্য বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে।
স্ট্রেংথ ট্রেইনিং ব্যায়াম শুধুমাত্র পেশী ভর বৃদ্ধি জন্যই উপকারী নয়; এটি তরুণ এবং বয়স্ক নারীদের হাড় ক্ষয়ের বিরুদ্ধেও কাজ করে।বিশেষ করে, যাদের অস্টিওপরোসিস (osteoporosis) বা ভঙ্গুর হাড় (brittle bones), অস্টিওপেনিয়া (osteopenia) বা হাড়ের কম ভর (low bone mass) অথবা যাদের স্তন ক্যান্সার রয়েছে তাদের জন্য এ ধরনের ব্যায়াম বিশেষ উপকারী।
হাড়ের ভর কম (low bone mass) এমন পুরুষদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও resistance training এবং weight-bearing exercise উভয়ই শরীরের বিভিন্ন জায়াগায় হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে, শুধু রেসিস্টেন্স ট্রেনিংও নিতম্ব হাড়কে একইভাবে প্রভাবিত করে।
সারাংশ: ভার বহন এবং প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ উভয় ব্যায়ামই হাড় গঠনকে জোরদার করে এবং বৃদ্ধ বয়সে হাড়ের স্বাস্থ্যকে ভাল রাখে। এছাড়া যাদের হাড়ের ঘনত্ব কম তাদের জন্যও এ দুটি ব্যায়াম উপকারী।
৩.পর্যাপ্ত প্রোটিন খান
সুস্থ হাড় গঠনের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে হাড়ের শতকরা ৫০ ভাগই তৈরি হয় প্রোটিন থেকে।
এ সংক্রান্ত গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পর্যাপ্ত প্রোটিনের অভাবে হাড়ের ক্যালসিয়াম শোষণের মাত্রা কমে যায় এবং এরফলে হাড় গঠন ব্যাহত হয় এবং হাড় ভঙ্গুর হয়।
তবে, অতিমাত্রায় কেলসিয়াম গ্রহণ করলেও আবার রক্তে এসিডিটি হয়ে হাড় থেকে ক্যালসিয়াস বের হয়ে যাবার ভয় থাকে। অবশ্য, গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যেসব লোক প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পর্যন্ত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য এবং তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পর্যাপ্ত উদ্ভিদ এবং ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে তাদরে ক্ষেত্রে এটি ঘটবে না।
গবেষকরা বলেন, হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধির জন্য, বিশেষ করে বয়স্ক নারীদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী।যেসব বয়স্ক নারী বেশি প্রোটিন খাদ্য গ্রহণ করেন তাদের হাড়ের ঘনত্ব বেশি হতে দেখা যায়। , ,
এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার মেনোপোজ নারীর(যাদের রজঃস্রাব সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে এবং আর গর্ভধারন সম্ভব নয়, যাদের গড় বয়স পয়তাল্লিশের উর্ধে)অংশগ্রহণে ছয় বছরের পর্যবেক্ষণমূলক একটি বড় গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ হারে প্রোটিন গ্রহণ করায় তাদের হাতের হাড় ভাঙার ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং নিতম্ব, মেরুদণ্ড সহ সারা শরীরের হাড়ের ঘনত্বও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
নিয়মিত প্রোটিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে বয়সকালে হাড়ের ভর বজায় থাকে। মহিলাদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৮৬ গ্রাম প্রটিন খাওয়া উচিত।এরচেয়ে কম প্রোটিন গ্রহণ করলে বাহু, মেরুদণ্ড, নিতম্ব এবং পায়ের হাড় দুর্বল হওয়ার আশংকা থাকে।
সারাংশ: প্রোটিন যুক্ত খাবার কম খেলে হাড়ের ক্ষয়ের ঝুঁকি থাকে।অন্যদিকে, নিয়মিত উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে বৃদ্ধ বয়সে এবং ওজন কমানোর সময় হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
৪. দিনে কয়েকবার উচ্চ-ক্যালসিয়াম খাবার খান
হাড়ের মধ্যে থাকা প্রধান খনিজ উপাদান হল কেলসিয়াম। এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।কারণ, হাড়ের পুরাতন কোষ সমূহ অনবরত ভেঙে যায় এবং তদস্থলে তৈরি হয় নতুন কোষ।বেশি করে কেলসিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে এই নতুন কোষ গঠন জোরদার হয়।তাই হাড়ের অবকাঠামো রক্ষা করতে এবং শক্তিশালী করতে প্রতিদিন কেলসিয়াম গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বেশিরভাগ মানুষের গড়ে প্রতিদিন অন্তত এক গ্রাম কেলসিয়াম গ্রহণ করা দরকার।তবে উঠতি বয়সীদের দৈনিক ১৩শ মিলিগ্রাম এবং বয়স্ক নারীদের দৈনিক ১২শ মিলিগ্রাম কেলসিয়াম গ্রহণ করা দরকার।
যাইহোক, আপনার শরীর সত্যিকারভাবে যতটা ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে, তা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। মজার বিষয় হল, আপনি যদি একবারে ৫শ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন, তাহলে আপনার শরীর হয়তো পুরোটা শোষণ করতে নাও পারে। কারণ আপনি হয়তো খুব কম পরিমাণে ভোগ করতে পারবেন এবং সেকারণে আপনার শরীরও খুব কম পরিমাণেই শোষণ করতে সক্ষম হবে।
সুতরাং সবচেয়ে ভাল হল, আপনার ক্যালসিয়াম গ্রহণকে সারাদিনের বিভিন্ন সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া; প্রত্যেকবার আহার গ্রহণের সময় নিম্নের তালিকা থেকে যে কোন একটি উচ্চ মাত্রার ক্যালসিয়ামযুক্ত খাদ্যকে আপনার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আপনি এটি করতে পারেন।
১. বীজ
২. পনির
৩. দই
৪.সার্ডিন এবং রেডিমেড স্যামন
৫. বিন্স ও ডাল
৬. কাজুবাদাম
৭. ঘোল প্রোটিন
৮. শাক সবুজের
৯. রুবার্ব -Rhubarb
১০. সুরক্ষিত খাদ্যে
১১. অমরনাথ
১২. Edamame এবং tofu [Edamame-এটি হল পা্ত্রের মধ্যে সেদ্ধ বা ভাঁপে রান্ন করা সবুজ সয়াবিনের একটি পদ।
Tofu-এটি হল ঘি দিয়ে তৈরি সয়াবিন ভর্তার একটি পদ।এটি প্রধানত এশিয়ায় এবং নিরামিষাশী রান্নায় ব্যবহার করা হয়]
১৩. সুরক্ষিত পানীয়
১৪. ডুমুর
১৫. দুধ
এছাড়া সাপ্লিমেন্টের চেয়ে খাদ্য থেকে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা বেশি ভাল। সম্প্রতি ১৫৬৭ জন লোকের উপর ১০ বছর মেয়াদী এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা সরাসরি খাদ্য থেকে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেছেন তাদের হৃদরোগের ঝুকি সামগ্রিকভাবে কমে গেলেও যারা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট করেছেন তাদের এই ঝুঁকি ছিল ২২% বেশি।
সারাংশ: ক্যালসিয়াম হল হাড়ের মধ্যে থাকা প্রধান খনিজ এবং হাড় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রতিদিন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। এবং এক সাথে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম ভক্ষণ না করে সারাদিনে বিভিন্ন সময়ে এটি গ্রহণ করতে হবে।
৫.প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন D এবং ভিটামিন K গ্রহণ করুন
শক্তিশালী হাড় গঠনের জন্য ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন কে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তার মধ্যে একটি হলো, এটি আপনার শরীরকে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সাহায্য করে।এটি ব্লাড লেভেল বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।আর অস্টিওপেনিয়া, অস্টিওপরোসিস এবং অন্যান্য হাড়ের রোগ থেকে বাঁচার জন্য রক্তের লেভেল কমপক্ষে ৩০ এমজি/এমএল (75 nmol/l) অর্জন করার জন্য সুপারিশ করা হয়।আর সেজন্যই বেশি করে ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন ডি গ্রহণের প্রবণতা কম, তাদের শরীরে ভিটামিন ডি’র লেভেলও কম; এ কারণে তাদের হাড়ের ঘনত্ব কম এবং ভরও কম। অন্যদিকে, যাদের ভিটামিনি ডি’র লেভেল ভাল, তাদের হাড়ের ঘনত্ব এবং ভরও বেশি। ,
কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভিটামিন ডি গ্রহণের প্রবণতা খুবই কমন হয়ে গেছে।বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন ডি’র ঘাটতিতে ভুগছে বলে জানা গেছে।
অথচ সূর্যালোক এবং চর্বিযুক্ত মাছ, লিভার এবং পনির থেকে আমরা সহজেই ভিটামিন ডি পেতে পারি।তবে অনেকেরই হয়তো ভিটামিন ডি’র কাঙ্ক্ষিত লেভেল বজায় রাখার জন্য প্রতিদিন অন্তত ২০০০ আইইউ পরিমাণ ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার প্রয়োজন হতে পারে।
ভিটামিন কে-টু (Vitamin K2)অস্টোকেলসিনকে রূপান্তর করে হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে। অস্টোকেলসিন একটি প্রোটিন, যা হাড় গঠনের কাজে যুক্ত। এই রূপান্ত অস্টোকেলসিনকে হাড়ের খনিজের মধ্যে জমাট বাঁধতে সক্ষম করে তোলে এবং হাড় থেকে ক্যালসিয়াম হ্রাসকে রোধ করে।
ভিটামিন কে টু’র সবচেয়ে কমন দুটি রূপ হচ্ছে MK-4 এবং MK-7। লিভার, ডিম এবং মাংস মধ্যে অল্প পরিমাণে MK-4 বিদ্যমান থাকে। আর পনির, sauerkraut এবং সয়াবিনের মত উত্তেজক খাদ্য সমূহ যা natto নামেও পরিচিত; সেগুলোর মধ্যে MK-7 পাওয়া যায়।
সুস্থ তরুণ মহিলাদের একটি ছোট সমীক্ষায় দেখা গেছে, MK-4 ‘র তুলনায় MK-7 supplements vitamin K2 blood level কে বেশি উন্নীত করে।
তবে অন্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন কে-টু’র উভয় ফর্মই অস্টোকেলসিন রূপান্তরে সাহায্য করে এবং শিশু ও বয়স্ক মহিলাদের হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে।
৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মহিলাদের উপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যারা MK-4 সমৃদ্ধ খাবার খেয়েছেন এক বছরে তাদের হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।অন্যদিকে যারা মনের সান্তনার জন্য ঔষধ গ্রহণ করেছেন তাদের হাড়ের ঘনত্ব কিছুটা কমেছে।
সারাংশ: খাদ্য অথবা সাপ্লিমেন্ট থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন D এবং K2 গ্রহণ হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষার সহায়ক।
৬.খুব কম ক্যালরির খাবার পরিহার করুন
খাদ্যে অতিমাত্রায় ক্যালরি কমানো কখনই ভাল ধারণা নয়।এর ফলে ধীরে ধীরে আপনার ম্যাটাবলিজম কমে যাবে, খাবার পরও ক্ষুধা থাকবে এবং পেশীভর কমবে, যা আপনার হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন এক হাজারেরও কম ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ হাড়ের ঘনত্ব কমায় এবং স্থূলতার জন্ম দেয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, একদল স্থূল মহিলা চার মাস ধরে প্রতিদিন মাত্র ৯২৫ ক্যালরি গ্রহণ করেছে এবং (রেসিস্টেন্স ট্রেনিং) শরীর চর্চাও করেছে; তা সত্ত্বেও তাদের নিতম্ব এবং উরুদেশের হাড়ের ঘনত্ব কমেছে।
বস্তুত, শক্তিশালী হাড় গঠন এবং তা বজায় রাখার জন্য এমন ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে হবে, যাতে প্রতিদিন অন্তত ১২০০ ক্যালরির ব্যবস্থা থাকবে।এতে প্রচুর প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এছাড়াও থাকতে হবে ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
উপসংহার: কম ক্যালরির খাদ্য-তালিকা অনুসরণ করলে, এবং তার সাথে যদি কঠোর শরীরচর্চাও যোগ হয়, তাহলে হাড়ের ঘনত্ব কমে। হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১২শ ক্যালরির ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে হবে।
৭.কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট
কোলাজেন সাপ্লিমেন্টও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভাল কাজ দিতে পারে।যদিও এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়নি, তবে প্রাথমিক সাক্ষ-প্রমাণে এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল বলে মনে করা হয়।
কোলাজেন হাড়ের মধ্যে থাকা প্রোটিনগুলোর মধ্যে প্রধান।এতে রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিডের কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান যা গ্লিসাইন, প্রোলাইন এবং লাইসিন নামে পরিচিত।এগুলো হাড়, পেশী, লিগামেন্ট ও অন্যান্য টিস্যু নির্মাণ করতে সহায়তা করে।
কোলাজেন এক ধরনের তন্তু জাতীয় প্রোটিন যা বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন প্রাণীর মাংস, যোজক কলা ও মেরুদণ্ডে পাওয়া যায়। আমাদের দেহের মোট প্রোটিনের ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কোলাজেন। জেলাটিনও এক ধরনের কোলাজেন।হালাল প্রাণীর হাড়, মাংস, ডিম থেকে কোলাজেন তৈরি করা যায়। খাবার তৈরি ও চিকিৎসায় কোলাজেন ব্যবহৃত হয়।
কোলাজেন হাইড্রোলাইস্যাট (Collagen hydrolysate) বা কোলাজেন hydrolyzate পশু হাড় থেকে আসে। এটি সাধারণত জেলাটিন নামেই পরিচিত। এটা অনেক বছর ধরে জয়েন্টের ব্যাথা উপশমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
যদিও বেশিরভাগ গবেষণায় আর্থ্রাইটিসের মত জয়েন্ট কন্ডিশনের ব্যাপারে কোলাজেনের প্রভাব বেশি প্রত্যাশা করা হয়, তবে হাড়ের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এর উপকারী প্রভাব আছে বলেই মনে হচ্ছে।
২৪ সপ্তাহ ব্যাপী একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, অস্টিওপরোসিস-এ আক্রান্ত postmenopausal পর্যায়ের নারীদেরকে কোলাজেন এবং হরমোন calcitonin সংমিশ্রণ খাওয়ানোর ফলে তাদের দেহে উল্লেখযোগ্যভাবে কোলাজেন ঘাটতি হ্রাস পায়।
সারাংশ:ক্রমবর্ধমান সাক্ষপ্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, কোলাজেনযুক্ত সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে কোলাজেন ঘাটতি রোধ করে হাড়ের স্বাস্থ্য অটুট রাখা যায়।
৮.একটি স্থিতিশীল ও স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন
পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে হাড়ের স্বাস্থ্য অটুট রাখতে সাহায্য করে।
হাড়ের সুরক্ষার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ বা স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা অপরিহার্য। ওজন কম হলে যেমন অস্টিওপেনিয়া (osteopenia) বা হাড়ের কম ভর (low bone mass) এবং অস্টিওপরোসিস (osteoporosis ) বা ভঙ্গুর হাড় (brittle bones)-এর ঝুঁকি বাড়ে। তেমনি স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনও হাড় ক্ষয় এবং ভঙ্গুর হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষ করে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া মধ্য বয়স্ক নারীদের হাড় সুরক্ষার হরমোন হ্রাসের কারণে জন্য এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।ওজন বয়সকালে হাড়ের ঘনত্ব হৃাস পাওয়ার মূল কারণ। ,
অন্যদিকে, কিছু সমীক্ষায় জানা গেছে, শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমলে হাড়ের মান দুর্বল হয় এবং বাড়তি ওজনের চাপের কারণে হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে। ,
যদিও ওজন হ্রাস সাধারণত হাড় ক্ষয়ের অন্যতম কারণ; তবে এটি ভাবিক ওজন ব্যক্তির চেয়ে স্থূলকায় ব্যক্তির জন্য বেশি প্রযোজ্য।
বারবার ওজন কমানো এবং বাড়ানো কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেকখঅনি ওজন কমানোও হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওজন কমানোর সময় যে হাড় ক্ষয় হয় তা ওজন ফিরে পাওয়ার পরও আর পূরণ হয় না।এ থেকে বুঝা যায়, চক্রাকারে ওজন কমানো এবং বাড়ানোর ফলে একজন ব্যক্তির যে হাড় ক্ষয় হয়, তা তার জীবদ্দশায় আর পূরণ হয় না।
সুতরাং একটি স্থিতিশীল স্বাভাবিক বা একটু সামান্য বেশি ওজনই হাড়ের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে মানানসই।
সারাংশ: খুব রোখা কিংবা খুব স্থূল হওয়া উভয়ই হাড়ের স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া বারবার ওজন কমানো এবং পুনরায় ওজন বাড়ানোর চেয়ে বরং স্থিতিশীল ওজন বজায় রাখার মাধ্যমেই হাড়ের ঘনত্ব সংরক্ষণে বেশি সাহায্য করতে পারে।
৯.খাদ্যতালিকায় রাখুন ম্যাগনেসিয়াম এবং জিংক
হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম এবং জিংক সহ অন্যান্য খনিজ পদার্থও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।ম্যাগনেসিয়ামের প্রধান কাজ হচ্ছে ভিটামিন ‘ডি–কে রূপান্তরিত করে ক্যালসিয়াম শোষণে সক্ষম ও সক্রিয় করে তোলা।
৭৩ হাজার নারীর অংশগ্রহণে এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব নারী প্রতিদিন ৪শ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের হাড়ের ঘনত্ব ২-৩% বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যেসব নারী এর অর্ধেক পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করেছেন বোন ডেনসিটি ছিল প্রথম দলের তুলনায় ২-৩% কম।
তবে বেশিরভাগ সাধারণ খাদ্যেই ম্যাগনেসিয়াম খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়।ম্যাগনেসিয়াম গ্লিসিনেট, সাইট্রেট অথবা কার্বোনেটের সাপ্লিমেন্ট এক্ষেত্রে উপকারে আসতে পারে।অবশ্য, খুব অল্প কয়েকটি খাদ্য রয়েছে, যেগুলো ম্যাগনেসিয়ামের ভাল উৎস হিসেবে স্বীকৃত।
জিংকও একটি খনিজ উপাদান এবং স্বল্প পরিমাণে হলেও এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য্য। জিংক হাড় গঠনের সেল সমূহকে জোরদার করতে সাহায্য করে এবং অতিমাত্রায় হাড় ভাঙ্গা রোধ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জিংক সাপ্লিমেন্ট শিশুদের হাড় গঠন জোরদার করতে সাহায্য করে এবং বৃদ্ধ বয়সে হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ,
জিংক বা দস্তার ভাল উৎস গুলোর মধ্যে রয়েছে গরুর মাংস, চিংড়ি, শাক, শণ-বীজ, ঝিনুক এবং কুমড়া বীজ।
এছাড়াও এখানে কয়েকটি এক্সক্লুসিভ জিংকযুক্ত খাবারের তালিকা দেয়া হল, যেগুলো জিংকের চাহিদা পূরণ করতে পারে:
1. ডার্ক চকলেট- Dark Chocolate
2. এ্যাভোকাডো- Avocados
3. বাদাম- Nuts
4. লিগামস-Legumes
5. টফু-Tofu
6. বীজ-Seeds
7. পুরো শস্য-Whole Grains
8. কিছু চর্বিযুক্ত মাছ-Some Fatty Fish
9. কলা-Bananas
10. সবুজ শাক-Leafy Greens
১০.খাদ্য তালিকায় রাখুন ওমেগা থ্রি ফ্যাট বা চর্বিযুক্ত মাছ
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড তাদের প্রদাহ-বিরোধী প্রভাবের জন্য সুপরিচিত।তারা বার্ধক্য প্রক্রিয়ার সময় হাড় ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতেও সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। , ,
তবে, আপনার খাদ্যতালিকায় ওমেগা-থ্রি ফ্যাট যোগ করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে, ওমেগা সিক্স থেকে ওমেগা থ্রি’র ভারসাম্য খুব বেশি হবে না।
এ বিষয়ে ৪৫-৯০ বছর বয়সী দেড় হাজারেরও বেশি একটি বড় গবেষণায় দেখা গেছে, যারা উচ্চ অনুপাতে ওমেগা সিক্স টু ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করেছেন তাদের হাড়ের ঘনত্ব কমেছে।কিন্তু যারা এই চর্বি দুটি কম মাত্রায় ভোগ করেছেন, তারা সুফল পেয়েছেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে, ওমেগা ৬ থেকে ওমেগা ৩-এর অনুপাত ৪:১ বা তারও কম হল সবচেয়ে ভাল।
উপরন্তু, যদিও অধিকাংশ গবেষণায় ওমেগা-৩ এর দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধাগুলো চর্বিযুক্ত মাছের মধ্যেই পাওয়া যায় বলে প্রত্যাশা করা হয়, তবে এক জোরালো গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-৩ হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে এবং হাড় গঠন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-৩ ফ্যাটের মধ্যে রয়েছে চিয়া সিডস(chia seeds), শণবীজ (flaxseeds) এবং আখরোট (walnuts)।
সারাংশ: ওমেগা -3 ফ্যাটি এসিড নতুন হাড় গঠন জোরদার করতে এবং বয়সকালে হাড়ের ক্ষয় থেকে সুরক্ষা পেতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।