নিজের কাজ বা চাকরি উপভোগ করা এবং কাজের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমন কিছু গুরুতর লক্ষণ রয়েছে যেগুলো খেয়াল করলেই বুঝবেন, আপনি হয়তো আপনার কাজকে একটু বেশিই সিরিয়াসলি নিচ্ছেন।
* সবার আগে অফিসে আসেন, যান সবার পরে
সারাদিনের কাজের ব্যস্ততা সামাল দিতে সকাল সকাল কাজ সামলে নেওয়া এবং পরের দিনের প্রস্তুতি হিসেবে টুকিটাকি কাজগুলো সন্ধ্যায় সেরে নেওয়া অবশ্যই আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং দুরদর্শিতার পরিচায়ক। কিন্তু আপনি যদি এমন বাধা ধরা রুটিনে আবদ্ধ হয়ে যান তাহলে ধরেই নিন আপনি আপনার কাজের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। অতিরিক্ত কাজের চাপ আপনাকে ক্লান্ত ও দূর্বল করে দেবে, পাশাপাশি আপনার মেজাজ হয়ে যাবে খিটখিটে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি সময় ধরে কাজ করলেই যে তা ফলপ্রদ হবে তা কিন্তু নয়। নব্বইয়ের দশকে ফোর্ড মোটর কোম্পানি একটি গবেষণা প্রকাশ করে যেখানে সাধারণ ৪০ ঘণ্টার সঙ্গে আরো অতিরিক্ত ২০ ঘণ্টা কাজের তেমন কোনো ইতিবাচক ফলাফল না পাওয়ার কথা বলা হয়। দৈনন্দিন জীবন এবং কাজের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হলে কাজের পিছনে দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি সময় দেবেন না।
* আপনি বিরতি নিতে পারেন না
মাঝেমধ্যে কাজ থেকে বিরতি নেওয়াটা বেশ জরুরি। আপনি বিরতি অর্থাৎ ছুটি নিতেই পারেন। ছুটিতে থাকা অবস্থায়, ঘুরে বেড়ানোর সময় আপনি যদি কাজের চাপ মাথায় নিয়ে ঘোরেন তাহলে আপনি সমস্যার মধ্যে আছেন। অফিস ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে অফিস সম্পর্কিত ডিভাইসগুলোতে নিরাপদে হাতের নাগালের বাইরে রাখুন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এমনকি ই-মেইল চেক করা কমিয়ে দিনে সর্বোচ্চ তিনবারের পরামর্শ দিয়েছেন-অফিসে আসার পর, মধ্যাহ্নভোজের পর এবং অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে। কাজের মধ্যে বেশি ডুবে গেলে আপনি আপনার বাস্তব জীবন থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়বেন।
* শরীরের দিকে খেয়াল রাখেন না
কাজের চাপে হয়তো আপনি শরীরের দিকে খেয়াল কম রাখেন তাই ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়েন। গবেষণায় দেখা গেছে, কাজের প্রতি আসক্ত ব্যক্তিগণ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানিসিক রোগের ঝুঁকিতে থাকেন, যার মধ্যে রয়েছে: টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক অবসাদ এবং বিষন্নতা। কাজে আসক্ত ব্যক্তিদের মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে এবং তারা সুস্থ পেশাজীবী হয়ে উঠতে পারেন না। এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ব্র্যায়ান ই রবিনসন বলেন, অসুস্থ অবস্থায় কাজ করার অর্থ হল ফলপ্রদ কাজের সময়টুকু আপনি নষ্ট করে ফেলছেন। সুতরাং তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নভোজ সেরে ফেলার জন্য ফাস্ট ফুডের আশ্রয় নেবেন না এবং অফিসে বেশি সময় থাকার কারণে শরীরচর্চার বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না। শরীরের প্রতি যত্ন নিন। এতে আপনার শরীরও ভালো থাকবে, বসও খুশি হবেন।
* কাজই আপনার জীবন
কাজের সফলতায় উচ্ছ্বসিত হওয়ার ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো একটি ব্যাপার। কিন্তু সেটিই যদি আপনার জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সমস্যা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ জুলিয়ান গর্ডন এ বিষয়ে বলেন, ‘কাজে আসক্ত ব্যক্তিগণ তাদের বস, সহকর্মী এবং গ্রাহকদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে যান। তারা মনে করেন তাদের বস, সহকর্মী এবং গ্রাহকদের যথাযথ মূল্যায়নই তার সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জায়গা।’ কাজের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে সফলতার আনন্দ খুঁজে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যেম: খেলাধুলা, গানবাজনা অথবা লেখালেখি।
* আপনার জীবনে কোন সখ নেই
আপনার সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার একমাত্র প্রেরণা যদি অফিস হয়ে থাকে তাহলে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। অফিস যাওয়ার পথে বা কাজের অবসরে আপনি শুধুমাত্র আপনার কাজ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না। বরঞ্চ এমন কিছু খুঁজে বের করুন যা আপনার ৯-৫টা চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। প্রয়োজনে আপনার শহরের সকল জাদুঘর ঘুরে বেড়ানোর একটি লক্ষ্য স্থির করুন অথবা কোনো এনজিওতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করুন সপ্তাহে একদিন। আপনি যখন অফিসের বাইরেও নিজেকে সময় দিতে শুরু করবেন তখন নিজের প্রতি আপনার আত্মতৃপ্তি বেড়ে যাবে।
* নিজের কাজে আপনি বরাবরই অসন্তুষ্ট
বিশেষজ্ঞ গর্ডনের মতে, ‘কাজের প্রতি আসক্ত ব্যক্তিরা জানেনা তাদের কাজের পরিপূর্ণতা কোথায়। তারা সবসময় বেশি বেশি চায় কিন্তু তারা এটা জানেনা যে, সফলতার আসল মানেটা কি।’ আপনার অতিরিক্ত করিৎকর্মা হয়ে ওঠার নেশা আপনাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলবে এবং প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। অবশ্যই আপনার কাজের মাধ্যমে ভালোটা করার চেষ্টা করুন, কিন্তু কখন আপনি থামবেন এটাও মাথায় রাখতে হবে। তাছাড়া আপনার এবং অন্যদের অর্জন সম্পর্কে চৌকষ থাকুন।
* আপনি সর্বদা বসনির্ভর, বন্ধুনির্ভর নন
আপনার কাজের ব্যস্ততার কারণে যদি বন্ধুদের সময় দিতে না পারেন তাহলে অবশ্যই এটি আপনার কাজের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির একটি কুফল। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্টেফানি মার্সটন বলেন, অফিসের কাজে অতিরিক্ত কিছু প্রজেক্ট আপনি নিতেই পারেন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, কখন ব্যাপারটা অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আপনার বসের সঙ্গে এ ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলতে ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে তাকে আপনার সকল অবস্থা সম্পর্কে অবগত করুন। আপনার দৈনন্দিন সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক বিভিন্ন কাজের জন্য সময় রাখুন। এর মাধ্যমে আপনি সারাদিন অফিসের নানান কাজের পর একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন।
* আপনি নিজেকে কাজে আসক্ত মনে করেন না
অন্যান্য বিভিন্ন আসক্তির মতো আপনার কাজে আসক্তির প্রধান এবং অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে, আপনি তা স্বীকার করেন না। মনোবিজ্ঞানী রবিনসন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কাজের প্রতি আসক্তি অনেকটা অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের আসক্তির মতো। যে ব্যক্তি কাজের প্রতি আসক্ত সে কোনোদিনই ব্যাপারটা মেনে নেন না বা স্বীকার করেন না। তাদের যে একটা সমস্যা রয়েছে সে বিষয়ে তারা বিন্দুমাত্র সচেতন নন।’ আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সময়দিন। তাছাড়া কাজে আসক্তির বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।