সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নানান রকমের হয়রানি ও প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলুন।
১. হাসপাতালে যে অপরিচিত লোকটি আপনার ঘনিষ্ট হিসাবে ডাক্তারকে পরিচয় দিবে, সে লোকটি একজন দালাল। শুরুতেই মার্ক করে রাখুন। এড়িয়ে চলুন।
ক) দালাল টাকা চাইবে। বলবে, “ডাক্তারকে টাকা দিলে ডাক্তার ভাল করে দেখবে”। আসলে মিথ্যে কথা। এই টাকা দালাল তার পকেটে ঢুকাবে। সরকারী
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখার জন্য ডাক্তার কখনই টাকা নেয়না।
খ) ডাক্তার বা নার্স সরকারি সাপ্লাইয়ের বাইরে ঔষধের লিস্ট দিলে দালাল বলবে, আসেন আমার পরিচিত দোকান আছে। কম দামে কিনে দেবো। তার সাথে গেলে সে আপনার সব টাকা মেরে দিবে।হসপিটালের সীমানার ভিতরে যে ঔষধের দোকান আছে সেখান থেকে ঔষধ কিনুন। প্রতারণার শিকার হবেননা।
গ) রোগীর পরীক্ষা/নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে সরাসরি আপনার রোগীর দায়িত্বরত ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করুন, কোথায় করাতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার পর নিজে গিয়ে পরীক্ষা/নিরীক্ষা করাবেন। দালালকে সাথে নিবেননা। দালালের কথা শুনলে আপনাকে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ টাকা গুনতে হবে।
২. জরুরী বিভাগ থেকে ভর্তির পর কাগজ টি নিজ হাতে বহন করে নিজের ওয়ার্ডে যাবার অভ্যাস করুন। তানাহলে বহনকারী লোকটি আপনাকে বড়সড় খরচ করিয়ে শুইয়ে দিতে পারে। দালালদের আর একটা কৌশল হল, রোগী ভর্তি হলেই
রোগীর এটেনডেন্ট কে বলবে, “হাসপাতালের এক্স রে মেশিন নষ্ট, অমুক টেস্ট হবে না, এই রোগের চিকিৎসা হবে না ইত্যাদি। তারপর নিজের পছন্দমত ক্লিনিকের নাম বলে সেখানে নিয়ে যাবে।
৩.ডিউটি ডাক্তাররা (ইন্টার্ন বা ইউনিটের সিএ, রেজিস্টার) উচ্চশিক্ষিত ও হাইলি কোয়ালিফাইড। সেখানে গিয়ে নিজের ক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যাতা, স্মার্টনেসের প্রমান দিতে যাবেন না। আপনি যতটুকু ভদ্রলোক হবেন, তারা তার চাইতে বেশি
ভদ্রলোকের মত আপনাকে চিকিৎসা দিবে।
৫. হাসপাতালের সব সিরিয়াস রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়, ইন্টার্ন/সিএ/রেজিস্টারের হাত দিয়েই। তারা জানে কিভাবে রোগীকে দ্রুত সময়ে প্রাণরক্ষাকারী চিকিৎসা দেওয়া হয়। বড় স্যার কবে দেখবে, কেন এখনো ডাক্তার
আসছে না বলে বোকামীর পরিচয় দিবেন না। কর্তব্যরত ডাক্তাররা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাদের বিরক্ত করবেননা। তারা আপনার রোগীর ব্যপারে অবশ্যই অবগত এবং আপনার রোগীর সব দায়িত্বও তার উপর।
৬. শুক্রবার হাসপাতালের প্রফেসর রাউন্ড বন্ধ থাকে। এইদিন বড় বড় ডাক্তার সচরাচর পাবেননা। এসময় বড় ডাক্তার
আসবেনা কেন বলে কর্তব্যরত ডাক্তারকে বিরক্ত করবেননা। ডাক্তার দেখে নাই বলে কাউকে অযথা বিব্রত করবেন না।
৭. হাসপাতাল থেকে সাপ্লাইকৃত ঔষুধ ডাক্তাররা দিবে না। সংশ্লিষ্ট ঔষুধের জন্য নার্স বা ইনচার্জকে ভদ্রভাষায় বলুন।
৮. রোগীর পাশ থেকে আপনার সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে সরিয়ে ফেলুন। তারা রোগীর কোন কল্যানে আসবে না।
তাদের জন্য চিকিৎসা দেরি হয়, এমনকি রোগী মারা যেতে পারে। যত মানুষ কম, রোগীর সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা তত বেশি।
৯. সরকারী হাসপাতালে বেড এর জন্য ঘ্যানঘ্যান করবেন না। এখানে কেউ বেড দখল করে শুয়ে থাকেনা। সবাই অসুস্থ্য রোগী। সেখানে মুচি ডোম শুয়ে থাকলেও তাকে নামিয়ে আপনাকে উঠানো যাবেনা। বেড না থাকলে একজন ডাক্তারের মা নিজে অসুস্থ্য হয়ে আসলেও তাকে মেঝেতেই থাকতে হবে। সকল রোগী সমান। বেড ও মেঝের সবাইকে সমান চিকিৎসা দেওয়া হয়।
১০. কোন রাজনৈতিক পরিচয় দেবার চেষ্টা করবেন না! সবচাইতে খারাপ কাজ এটা। মনে রাখবেন, ঝামেলা এড়ানোর জন্য সকল ডাক্তার ঐ রোগীর কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। দিনশেষে ক্ষতিটা আপনারই।
১০. আপনার রোগীকে ডাক্তার বারবার কেন দেখছেনা, সেজন্য ডাক্তারকে বিরক্ত করবেননা। মনে রাখতে হবে হসপিটালে প্রত্যেকটা রোগীর ব্যপারে ডাক্তার সম্পুর্ন
ওয়াকিফহাল এবং রোগীদের যে কোন ক্ষতির জন্য ডাক্তাররা দায়ীত্বশীল।রোগীরা হাসপাতালে আসার পর ডাক্তাররা খারাপ রোগী এবং সেইফ রোগী আলাদা করে ফেলেন। যারা সেইফ তাদের কাছে কম যান এবং যারা খারাপ তাদের কাছে বারবার যান। খারাপ এবং সেইফ রোগীর লিস্ট ডাক্তারদের হাতেই আছে। যা আপনি জানেন না।
১১. রোগী খাবে কি… বলে বারবার বিরক্ত করবেন না। যদি স্যালাইন চলে তাহলে ভেবে নিন তাকে আলাদা করে খাওয়াতে হবেনা। খাবার বন্ধ রাখা হয় রোগীর ভালোর জন্যই। খাবার প্রয়োজন হলে ডাক্তার নিজেই বলবে রোগীকে খাওয়ানোর জন্য।
১২. ক্যানুলা খুলে গেছে, স্যালাইন অফ কেন, ঔষুধ কখন খাবে, কিভাবে খাবে, ঔষুধটা চেক করে দিন তো….! এগুলোর জন্য ডাক্তারকে বিরক্ত করবেননা। এই
প্রশ্নগুলো নার্সকে ভদ্রভাষায় জিজ্ঞাসা করুন। সাধারণত এগুলো তাদের দায়িত্ব। তারাও শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাদের সম্মান করুন। এইগুলা ডাক্তারের কাজ নয়।
১৩. যেকোন পুরুষ ডাক্তারকে ডক্টর বা’স্যার’ ও মহিলা ডাক্তারকে ডক্টর বা ‘ম্যাম/ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করুন। একইভাবে মহিলা ও পুরুষ নার্সকে সিস্টার- ব্রাদার বলুন। আয়া বা কর্মচারীদের মামা ও খালা হিসাবে সম্বোধন করবেন। এগুলো আপনাকে ছোট করবে না বরং সম্মানীয় বানাবে। ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরাও আপনাকে
সাহায্য করবে।
১৪. থুথু ও পানের পিক নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন। জায়গা না থাকলে মাঝেমাঝে গিলে খাবার অভ্যাস করুন। আপনি হাসপাতাল যতটুকু নোংরা করবেন, বাকী সবাই আপনার ফেলানো থুথু দেখে সেখানে থুথু ফেলে ভাসিয়েয়ে দিবে। অপরাধের শুরুটা কিন্তু আপনিই করলেন।
১৫)লিফট ম্যান/ট্রলি ম্যান/গেইট ম্যান টাকা নিলো কেনো, এসবের জন্য চ্যাঁচামেচি করবেননা। মনে রাখবেন
কিছু বিষয় মেনে নেওয়াই মঙ্গল।
১৬)ডাক্তার যদি বলে রক্ত লাগবে তাহলে কোন রকম প্রশ্ন না করে চুপচাপ রক্ত সংগ্রহ করুন। সংগ্রহ করতে ব্যার্থ হলে ডাক্তারের কাছে বিনয়ের সাথে সাহায্য
চান।প্রতিদিন ডাক্তাররা নিজের রক্ত দিয়ে অনেক রোগীর জীবন বাচান বিনা টাকায়।
১৭.ডাক্তার যদি রোগী রেফার্ডের কথা বলে তাহলে এক মুহূর্ত দেরী না করে রোগীকে উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে
রোগীকে নির্দিষ্ট হসপিটালে নিয়ে যাবেন।
হাসপাতালের ডাক্তারদের উপর বিশ্বাস
রাখুন। আপনি নিশ্চিত লাভবান ই হবেন।
১৮. রোগী মারা গেলে ডাক্তারকে গালিগালাজ না করে স্বস্ব ধর্মের সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন। ডাক্তার একজন মানুষ। তিনি শুধু চেষ্টা করতে পারেন।
১৯.অধিক জনসংখ্যা,চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত অব্যবস্থাপনার জন্য আপনার কাঙ্ক্ষিত
সেবা অনেক সময় নাও পেতে পারেন। এর জন্য চিৎকার/ চ্যাঁচামেচি/মারামারি না করে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করে যান।
উপরের আলোচনাটি শুধুমাত্র সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের সুবিধার জন্য আলোচনা করা হয়েছে। এর সাথে অন্যান্য সরকারী হাসপাতাল, প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা প্রাইভেট চেম্বারের বিষয় গুলি গুলিয়ে ফেলে অযথা কথা বাড়াবেন না আশা করি।
কার্টেসীঃ মোবারক হোসেন খান